ঢাকা ০১:০৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ৩০ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সৌদি আরব

ইতিহাসের শহর জেদ্দার আল-বালাদ

আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের মিশেল ঝকমকে শহর সৌদি আরবের জেদ্দা। এ শহরে পুরোনো ইতিহাসের স্বাদ নিতে যেতে হবে আল-বালাদ। শত শত বছরের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে শহরটি। সময়ের সঙ্গে আধুনিকায়নের ঢেউ এলেও এলাকাটি এখনো ধরে রেখেছে অতীত ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যশৈলীর সৌন্দর্য।

আধুনিক জেদ্দার কোলাহলপূর্ণ রাস্তা পেরিয়ে যখন পুরোনো শহর আল-বালাদে পৌঁছালেই মনে হবে সময় যেন থমকে গেছে। সরু গলি, প্রাচীন শৈলীর ভবন, আরবের ঐতিহ্যবাহী বাজার—সবকিছু এক অনন্য অনুভূতি এনে দিবে।

আল-বালাদে ঢুকতে প্রথমেই চোখে পড়বে বাবে মক্কা। এটি জেদ্দার ঐতিহাসিক প্রবেশপথ। শত শত বছর ধরে হাজিরা এই পথ দিয়ে মক্কার পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করতেন। এখানে দাঁড়িয়ে মনে হবে, ইতিহাসের এক মহৎ অধ্যায়ের সামনে দাঁড়িয়েছি।

জেদ্দার ঐতিহাসিক প্রবেশপথ বাবে মক্কা

একটু সামনে এগুলেই পাওয়া যাবে নাসিফ হাউস। ১৯২০ সালে বাদশা আব্দুল আজিজ এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর কাঠের জানালা ও মাটি-পাথরের সংমিশ্রণে তৈরি স্থাপত্য সৌদি আরবের প্রাচীন জীবনযাত্রার গল্প বলে। একসময় এই ভবন রাজপরিবারের সদস্যদের আবাসস্থল ছিল।

১৯২০ সালে বাদশা আব্দুল আজিজ এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নাসিফ হাউস

নাসিফ হাউস পেরিয়ে হাটতে থাকলেই দেখা যাবে অনেকগুলো পুরোনো ভবন। এর বেশিরভাগই সপ্তম শতকের স্থাপত্য। চমৎকার এসব স্থাপত্য পর্যটকদের নিয়ে যায় কয়েক হাজার বছর পেছনে। আল-বালাদের বেশ কিছু ভবন ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সৌদি সরকার ২০৪০ সাল পর্যন্ত এসব স্থাপনা সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে দুটি ভবন—একটি প্রাচীন জেলেদের প্রতীক, অন্যটি সৌদি আরবের শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে রয়ে গেছে।

২০২১ সালে সৌদি যুবরাজ ও প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ জেদ্দার ঐতিহাসিক জেলা পুনরুজ্জীবিতকরণ প্রকল্প চালু করেন। এ প্রকল্পের লক্ষ্য জেদ্দার ঐতিহাসিক স্থাপত্যকে পুনরায় বিকশিত করা, বসবাসের জন্য উন্নত করা এবং সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোতে বিনিয়োগ করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখা।

এসব ভবনের মাঝে হাটতে হাটতেই সামনে পড়বে বেদুইন মার্কেটে। মনে হবে, যেন কয়েক দশক আগের সৌদি আরবে চলে এসেছি। পুরোনো আসবাব, ঐতিহ্যবাহী পোশাক, হাতে তৈরি গয়না, এমনকি সৌদিদের ঐতিহ্যবাহী খাবার পাওয়া যায় এখানে। সন্ধ্যার পর এখানকার পরিবেশ জমে ওঠে। স্থানীয় বাসিন্দারা মেতে ওঠেন প্রাচীন খেলা, গান, গল্প ও আড্ডায়।

আগ্রহী ক্রেতাদের জন্য এই শহরের বিভিন্ন রাস্তায় কেনাকাটার সুযোগ আছে নানা ধরনের মসলা, গয়না, টেক্সটাইল ও পারফিউমের মতো পণ্য। স্মৃতি হিসেবে নেয়ার জন্য পাওয়া যাবে হরেক রকম স্যুভেনির। রাস্তার পাশের এসব দোকান ছাড়াও বিশেষ কিছু আকর্ষণ আছে এই জায়গায়। যেমন: সুন্দর গয়নার জন্য যাওয়া যাবে আল বালাদ গোল্ড মার্কেটে। আর লেখকদের লেখা ফিকশন কিংবা ঐতিহাসিক বইয়ের জন্য যেতে পারেন আওয়ার ডেইজ অফ ব্লিস বুকশপে।

ঐতিহ্যবাহী জেদ্দা শত শত বছর ধরে সমুদ্রপথে আসা হজযাত্রীদের স্বাগত জানিয়েছে এবং ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যপথের মাধ্যমে আমদানি করা পণ্য গ্রহণ করেছে। এটি ৯টি প্রবেশদ্বারসমৃদ্ধ ঐতিহাসিক শহর। প্রতিটি প্রবেশদ্বারের নিজস্ব ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। একসময় এটি প্রাচীরবেষ্টিত শহর ছিল। এর প্রাচীর ১৫১৭ সালে পর্তুগিজদের অবরোধ থেকে জেদ্দাকে রক্ষা করেছিল।

ঐতিহ্যবাহী জেদ্দার ইউনেসকো স্বীকৃতি লাভের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এই শহর রেড সি অঞ্চলের মানবিক মূল্যবোধ, নির্মাণসামগ্রী ও স্থাপত্যকৌশলের আদান-প্রদানের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। বাণিজ্য ও হজযাত্রার কেন্দ্রবিন্দু এবং রেড সি সাংস্কৃতিক অঞ্চলের একমাত্র টিকে থাকা নগর। এ ছাড়া হজের সঙ্গে প্রতীকী, অবৈষয়িক, স্থাপত্য ও নগর-পরিকল্পনার স্তরে এটি গভীরভাবে সম্পর্কিত।

অটোমান সাম্রাজ্যের শাসনামলে আল-খেদির মসজিদ নির্মিত হয়

সম্প্রতি সৌদি ট্যুরিজম অথরিটি (এসটিএ) দেশটির ঐতিয্যবাহী ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাগুলো বিশ্ববাসির সামনে তুলে ধরার উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে চলতি বছর থেকে ওমরাহ হাজিগণ সৌদি আরবের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করতে পারবেন মর্মে রাজকীয় সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে অবহিত করা হয়েছে।

আল-বালাদের বড় একটি এলাকা ঘুরে মনে হবে, আধুনিক সৌদি আরবের পেছনে লুকিয়ে থাকা সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু বদলেছে; কিন্তু আল-বালাদের এই পুরোনো স্থাপনাগুলো এখনো সৌদি আরবের অতীতের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। জেদ্দার আল-বালাদ শুধু একটি জায়গা নয়, এটি একটি ইতিহাস, একটি সংস্কৃতি, একটি অনুভূতি—একবার ঘুরতে গেলে হৃদয়ে গেঁথে যায়।

আলোচিত

গৌরীর জন্য বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমিরের

সৌদি আরব

ইতিহাসের শহর জেদ্দার আল-বালাদ

০২:৫৬:২৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ মার্চ ২০২৫

আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের মিশেল ঝকমকে শহর সৌদি আরবের জেদ্দা। এ শহরে পুরোনো ইতিহাসের স্বাদ নিতে যেতে হবে আল-বালাদ। শত শত বছরের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে শহরটি। সময়ের সঙ্গে আধুনিকায়নের ঢেউ এলেও এলাকাটি এখনো ধরে রেখেছে অতীত ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যশৈলীর সৌন্দর্য।

আধুনিক জেদ্দার কোলাহলপূর্ণ রাস্তা পেরিয়ে যখন পুরোনো শহর আল-বালাদে পৌঁছালেই মনে হবে সময় যেন থমকে গেছে। সরু গলি, প্রাচীন শৈলীর ভবন, আরবের ঐতিহ্যবাহী বাজার—সবকিছু এক অনন্য অনুভূতি এনে দিবে।

আল-বালাদে ঢুকতে প্রথমেই চোখে পড়বে বাবে মক্কা। এটি জেদ্দার ঐতিহাসিক প্রবেশপথ। শত শত বছর ধরে হাজিরা এই পথ দিয়ে মক্কার পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করতেন। এখানে দাঁড়িয়ে মনে হবে, ইতিহাসের এক মহৎ অধ্যায়ের সামনে দাঁড়িয়েছি।

জেদ্দার ঐতিহাসিক প্রবেশপথ বাবে মক্কা

একটু সামনে এগুলেই পাওয়া যাবে নাসিফ হাউস। ১৯২০ সালে বাদশা আব্দুল আজিজ এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর কাঠের জানালা ও মাটি-পাথরের সংমিশ্রণে তৈরি স্থাপত্য সৌদি আরবের প্রাচীন জীবনযাত্রার গল্প বলে। একসময় এই ভবন রাজপরিবারের সদস্যদের আবাসস্থল ছিল।

১৯২০ সালে বাদশা আব্দুল আজিজ এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নাসিফ হাউস

নাসিফ হাউস পেরিয়ে হাটতে থাকলেই দেখা যাবে অনেকগুলো পুরোনো ভবন। এর বেশিরভাগই সপ্তম শতকের স্থাপত্য। চমৎকার এসব স্থাপত্য পর্যটকদের নিয়ে যায় কয়েক হাজার বছর পেছনে। আল-বালাদের বেশ কিছু ভবন ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সৌদি সরকার ২০৪০ সাল পর্যন্ত এসব স্থাপনা সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে দুটি ভবন—একটি প্রাচীন জেলেদের প্রতীক, অন্যটি সৌদি আরবের শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে রয়ে গেছে।

২০২১ সালে সৌদি যুবরাজ ও প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ জেদ্দার ঐতিহাসিক জেলা পুনরুজ্জীবিতকরণ প্রকল্প চালু করেন। এ প্রকল্পের লক্ষ্য জেদ্দার ঐতিহাসিক স্থাপত্যকে পুনরায় বিকশিত করা, বসবাসের জন্য উন্নত করা এবং সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোতে বিনিয়োগ করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখা।

এসব ভবনের মাঝে হাটতে হাটতেই সামনে পড়বে বেদুইন মার্কেটে। মনে হবে, যেন কয়েক দশক আগের সৌদি আরবে চলে এসেছি। পুরোনো আসবাব, ঐতিহ্যবাহী পোশাক, হাতে তৈরি গয়না, এমনকি সৌদিদের ঐতিহ্যবাহী খাবার পাওয়া যায় এখানে। সন্ধ্যার পর এখানকার পরিবেশ জমে ওঠে। স্থানীয় বাসিন্দারা মেতে ওঠেন প্রাচীন খেলা, গান, গল্প ও আড্ডায়।

আগ্রহী ক্রেতাদের জন্য এই শহরের বিভিন্ন রাস্তায় কেনাকাটার সুযোগ আছে নানা ধরনের মসলা, গয়না, টেক্সটাইল ও পারফিউমের মতো পণ্য। স্মৃতি হিসেবে নেয়ার জন্য পাওয়া যাবে হরেক রকম স্যুভেনির। রাস্তার পাশের এসব দোকান ছাড়াও বিশেষ কিছু আকর্ষণ আছে এই জায়গায়। যেমন: সুন্দর গয়নার জন্য যাওয়া যাবে আল বালাদ গোল্ড মার্কেটে। আর লেখকদের লেখা ফিকশন কিংবা ঐতিহাসিক বইয়ের জন্য যেতে পারেন আওয়ার ডেইজ অফ ব্লিস বুকশপে।

ঐতিহ্যবাহী জেদ্দা শত শত বছর ধরে সমুদ্রপথে আসা হজযাত্রীদের স্বাগত জানিয়েছে এবং ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যপথের মাধ্যমে আমদানি করা পণ্য গ্রহণ করেছে। এটি ৯টি প্রবেশদ্বারসমৃদ্ধ ঐতিহাসিক শহর। প্রতিটি প্রবেশদ্বারের নিজস্ব ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। একসময় এটি প্রাচীরবেষ্টিত শহর ছিল। এর প্রাচীর ১৫১৭ সালে পর্তুগিজদের অবরোধ থেকে জেদ্দাকে রক্ষা করেছিল।

ঐতিহ্যবাহী জেদ্দার ইউনেসকো স্বীকৃতি লাভের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এই শহর রেড সি অঞ্চলের মানবিক মূল্যবোধ, নির্মাণসামগ্রী ও স্থাপত্যকৌশলের আদান-প্রদানের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। বাণিজ্য ও হজযাত্রার কেন্দ্রবিন্দু এবং রেড সি সাংস্কৃতিক অঞ্চলের একমাত্র টিকে থাকা নগর। এ ছাড়া হজের সঙ্গে প্রতীকী, অবৈষয়িক, স্থাপত্য ও নগর-পরিকল্পনার স্তরে এটি গভীরভাবে সম্পর্কিত।

অটোমান সাম্রাজ্যের শাসনামলে আল-খেদির মসজিদ নির্মিত হয়

সম্প্রতি সৌদি ট্যুরিজম অথরিটি (এসটিএ) দেশটির ঐতিয্যবাহী ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাগুলো বিশ্ববাসির সামনে তুলে ধরার উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে চলতি বছর থেকে ওমরাহ হাজিগণ সৌদি আরবের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করতে পারবেন মর্মে রাজকীয় সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে অবহিত করা হয়েছে।

আল-বালাদের বড় একটি এলাকা ঘুরে মনে হবে, আধুনিক সৌদি আরবের পেছনে লুকিয়ে থাকা সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু বদলেছে; কিন্তু আল-বালাদের এই পুরোনো স্থাপনাগুলো এখনো সৌদি আরবের অতীতের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। জেদ্দার আল-বালাদ শুধু একটি জায়গা নয়, এটি একটি ইতিহাস, একটি সংস্কৃতি, একটি অনুভূতি—একবার ঘুরতে গেলে হৃদয়ে গেঁথে যায়।